ছবি'র জগতে ফ্রান্সের 'ইম্প্রেশনিজম' আন্দোলনের সূচনা হয় একদল অ্যাডভেঞ্চারাস তরুণ-তরুণী'র হাত ধরে ! সনাতন সব নিয়ম-কানুন ভেঙে এই ছেলে-মেয়েগুলো এঁকে যাচ্ছিল একের পর এক আলো আর উচ্ছাসে ভরা জীবনের বাস্তব সব পেইন্টিংস ! কিন্তু একই সময়ে তাদের ব্যক্তিজীবনে নেমে আসছিল নানারকম বিপর্যয় আর সম্ভাবনা, কমেডি আর ট্রাজেডি'র খেলা। আজ বলতে এসেছি এক ট্র্যাজিক হিরো'র গল্প - যে শিল্পী এসেছিলেন অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে, কিন্তু পরিণত বিকাশের সময় তিনি কখনও পান নি। যে চার বন্ধু'র হাত ধরে 'ইম্প্রেশনিজম'-এর যাত্রা শুরু, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন - ফ্রেডরিখ বাযিল (Jean Frédéric Bazille)।
| বাযিলের সেল্ফ-পোর্ট্রেট |
বাযিলের জন্ম ১৮৪১-এর ডিসেম্বরে, মঁপেলিয়ে'তে (Montpellier)। জায়গা'টা প্যারিস থেকে বেশ খানিকটা দূরে, ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে। এই অঞ্চলে আঙুরের ফলন হয় বেশ ভাল, আর সেই আঙুর থেকে তৈরি হয় মোটামুটি জনপ্রিয় লোকাল ওয়াইন। বাযিলের বাবা'র ছিল ওই ওয়াইন প্রস্তুতের ব্যবসা, অর্থকড়ির অভাব ছিল না তাদের। বাবা'র ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হবে, কিন্তু ছেলের আগ্রহ দেখা গেল পেইন্টিং-এ ! অবশেষে, পরিবার থেকে তার পেইন্টিং শেখার অনুমতি দেয়া হল, কিন্তু শর্ত হল - একই সাথে মেডিসিনে পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে হবে ! দুই মহৎ উদ্দেশ্য এক করে বাযিল চলে আসলেন প্যারিসে, ১৮৬২ সালে। রুপকথা'র গল্প হলে বলতাম, 'ভাগ্যের দেবতা তখন প্রসন্নের হাসি হাসলেন'; কিন্তু ভাগ্যই হোক বা বাস্তবতা - বাযিল গিয়ে ভিরলেন চার্লস গ্লেয়ার (Charles Gleyre)-এর স্টুডিওতে। গ্লেয়ার ছিলেন ঐ সময়ের অন্যান্য সনাতন একাডেমিক শিল্পীদের চেয়ে অনেকটা লিবারেল, আর প্রতিভার কদর বুঝতেন লোক'টা। ভাগ্যের ব্যাপারটা যা বলছিলাম - ঠিক ওই সময়ই প্যারিসের বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ক'জন তরুণ শিক্ষার্থী তুলি-ক্যানভাস হাতে গ্লেয়ারের স্টুডিওতে যোগ দিতে আসছিলেন, যারা হয়ে উঠবেন বাযিলের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যে ছেলেগুলো আর্টের ক্ষেত্রে হয়ে উঠবে প্রত্যেকে একেকজন আইকনিক ফিগার, যে নামগুলো'র কথা শিল্পজগতের পরবর্তী ইতিহাস কখনই ভুলতে পারবে না - ক্লদ অস্কার মনে', পিয়ের-আগুস্তে রেনোয়া আর আলফ্রেড সিসলী !
| পোর্ট্রেট অফ বাযিল; রেনোয়া'র আঁকা |
বাযিল এইসব শিল্পীদের যে শুধু টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিলেন, তাই নয়; এরপর দিতে থাকলেন একের পর এক অভিনব আইডিয়া'ও। স্বভাবসুলভ ভাবেই তারা কনভেনশনাল আর্ট ছেড়ে বাস্তব জীবনের ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন, বাযিল প্রথমবারের মত প্রস্তাব করেন - আউটডোরে গিয়ে সত্যিকার মডেল'দের দিয়ে লাইফ-সাইজ ফিগার পেইন্টিং করলে কেমন হয়? 'লাইফ-সাইজ ফিগার পেইন্টিং' (সত্যিকার মানুষের সাইজের পেইন্টিং) আগে যে হতো না, তা নয়। তবে সবটাই হত শিল্পীদের বড় বড় স্টুডিওতে - আর ছবিগুলো বিষয়বস্তুও হতো কোনও এপিক যুদ্ধ বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কিন্তু সুবিশাল একটা ক্যানভাস নিয়ে রাস্তা-ঘাটে দাঁড়িয়ে একদম সাধারণ লোকজনের ছবি আঁকা হবে - এ ধরণের ওয়াইল্ড চিন্তা কার মাথায় আসে? বাযিলের এসেছিল। তিনি নিজে কখনও এ'কাজ করে যেতে পারেন নি, কিন্তু পরবর্তীতে মনে' ঠিকই করে গিয়েছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন অপূর্ব এক মাস্টারপিস। ওই ছবিটা নিয়েও আলাদা গল্প আছে একটা। মনে'কে নিয়ে যদি কখনও পোস্ট দিই, তখন বলব।
তার ইচ্ছে'র সেই 'লাইফ-সাইজ ফিগার পেইন্টিং' করে যেতে না পারলেও বাযিল যা করলেন সেটাও কম না। ২৬ বছর বয়সে বেশ বড়সড় ক্যানভাসে বাযিল আঁকলেন তার মাস্টারপিস Family Reunion of 1867–1868 (Musée d'Orsay, Paris)। বিশালাকায় ছবিতে বাযিল মাউন্ট-অলিম্পাসের দেব-দেবীদের আঁকলেন না, আদি বাইবেলীয় অ্যাডাম-আব্রাহাম-ডেভিড (আদম-ইব্রাহীম-দাউদ)-এর এপিকও না, তিনি আঁকলেন তার বাপ-মা, বোন, খালাত ভাই, ইয়ার-বান্ধবদের ! বিশাল ক্যানভাসে ব্যাপারটা তখনকার হিসেবে অভিনব। তবে মূল চমক'টা সেখানে না; আগে ছবিটা দেখুন -
| Family Reunion of 1867–1868 (Musée d'Orsay, Paris) |
নিচের ছবিটাও দেখুন। ২৩ বছর বয়সে আঁকা তার আরেকটা বিখ্যাত ছবি।
| View of the village, Castelnau |
এই ছবি দেখে তরুণী ইম্প্রেশনিস্ট বার্থ মরিস' তার বোনকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, "Bazille has done something I like greatly: A young girl wearing a light-colored dress sits in the shade of a tree. Behind in the distance, a village can be seen. The picture is full of light and sunshine. What he has attempted to do is what we have so often tried to do, depict a figure in the open air. And it seems to me that he has succeeded."
[History of Impressionism by John Rewald, Cologne 2001]
রৌদ্র-ছায়ার এই লুকোচুরি খেলা ছাড়াও পেইন্টিং-এর অন্যান্য ফর্মেও বাযিল দেখিয়ে গেছেন তার দক্ষতার ছাপ। যেমন অসাধারণ কিছু স্টিল লাইফ~
১৮৭০-এর গ্রীষ্মে শুরু হল ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ !
ফরাসীদের আর্মিতে যোগদানের চাপ আসতে লাগল। এদুয়ার্দ মানে, দেগা, মরিস' প্যারিসেই গা-ঢাকা দিলেন, ফরাসী-বংশোদ্ভূত না হওয়ায় সিসলী'র যুদ্ধে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না, পল সেজান সরে গেলেন দক্ষিণে মার্সেই'য়ের দিকে, আর ক্লদ মনে' এবং কামিল পিসারো তাদের বাক্স-পেটরা গুছিয়ে সোজা চলে গেলেন লন্ডনে ! তবে... ফ্রেডরিখ বাযিল গেলেন ফরাসী রণাঙ্গনে ! সে বছর নভেম্বরের ২৮ তারিখ। বঁ-লা-রোলান্দের যুদ্ধে বাযিলের অফিসার আহত হয়ে পড়লে তৎক্ষণাৎ পুরো ইউনিটের দায়িত্ব কাঁধে তুলে জার্মান ঘাঁটি আক্রমণের নেতৃত্ব দেন বাযিল। কিন্তু জার্মানদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে ফরাসী ইউনিট। রণক্ষেত্রেই নিহত হন আমাদের শিল্পী। এর সপ্তাহখানেক পর বাবা'র কাঁধে নিথর লাশ হয়ে বাযিল ফিরে আসেন তার প্রিয় 'আঙুর আর ওয়াইনের' সবুজভূমিতে... যেখানে তখনও অবিরত চলছে রৌদ্র-ছায়া'র লুকোচুরি খেলা।
সেই এক পৃথিবী'র গল্প বলা এখনও বাকি। গল্পটা সবে শুরু...
সমস্ত ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল ডট কম এবং উইকিপিডিয়া
তথ্য সূত্র:
* বই - Impressionism: A Celebration of Light, by Isabel Kuhl, Parragon books.
* টিভি ডকুমেন্টারী - The Impressionists Painting and Revolution, BBC.
* ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব।
অন্যত্র প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/shahedk/29838697
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন