মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

ছবি [আরেকটা (প্রায়) ডিটেকটিভ গল্প]

এক.

তানিয়া ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল ইনস্পেক্টর ওয়াদুদ ড্রয়িংরুমে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, লাইট অন করা হয় নি; ঘর অন্ধকার।
"কী হল, পাপা? শরীর খারাপ?"
"না মা। তোর কী খবর? ক্লাস কেমন চলছে?"
তানি মিস্টি হাসল। ওয়াদুদের হঠাৎ মনে হল, তিনি কেমন বহিরাগতের মত প্রশ্ন করছেন ! ব্যস্ততার কারণে মেয়ের সাথে কতদিন গল্প করা হয় না আর। ওয়াদুদ আধশোয়া থেকে উঠে বসলেন, "আয় তোর সাথে আজ কিছুক্ষণ গল্প করি। অনেকদিন তোকে সময় দেয়া হয় না..."
"তুমি বসো, পাপা", তানি হেসে তাকালো, "আমি একটু ফ্রেশ হয়ে চা করে নিয়ে আসি। চা খাবে তো?"
তানি অন্ধকারেই দেখতে পেল ওয়াদুদ হাসিমুখে সায় জানালেন।
চায়ের কাপ হাতে তানিয়া রুমে ঢুকতেই ওয়াদুদ হঠাৎ আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন, "আচ্ছা তানি, তুই তো অনেক পড়াশোনা করিস। মডার্ন আর্ট সম্পর্কে তোর কী ধারণা বল তো?"

"হঠাৎ?", তানি অবাক হয়ে চোখ তুলল।
"না...", ওয়াদুদ একটু থেমে বললেন, "আজ তোকে পেইন্টিং নিয়ে একটা খুব ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে পারি। তার আগে বল, মডার্ন আর্ট নিয়ে তোর ধারণা কী?"
তানি কৌতুহলে সামনে এগিয়ে আসল, "আমার কী ধারণা মানে? আমার আবার কী ধারণা হবে? কী জানতে চাও সেটাই বলো"
"না মানে, কিছু কিছু মডার্ণ আর্ট দেখে তোর মনে হয় না - অনর্থক রঙের ছড়াছড়ি? বাস্তব কিছু যদি না থাকে, সেই পেইন্টিং-এর কি কোনও মানে হয়?"
তানি হালকা হেসে উঠল, "পাপা শোনো, তোমার প্রশ্ন আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে বোর করব না, আমি খুব সংক্ষেপে আমার থিওরি জানাচ্ছি। আমার ধারণা, চিত্রশিল্প বিষয়টা আসলে অনেকটা কবিতার মত। অনেক আগে কাব্যে লেখা হত শুধু রাজা-বাদশা'দের বীরত্বগাঁথা আর পৌরাণিক কাহিনী। চিত্রশিল্পও ছিল তা-ই। মহারাজা-জমিদারদের ছবি, অথবা ঐতিহাসিক-পৌরাণিক সব বিষয়বস্তু। যখন থেকে সব কাহিনী গদ্যে লেখা হতে শুরু করল, তখন থেকে কবিতা আস্তে আস্তে হয়ে গেল মুক্ত। গল্প-কাহিনী তো মনে করো সব 'গদ্যে'ই বলা যায়, তাই কবিতায় কাহিনী'র চেয়ে জোরালো হয়ে উঠল অনুভূতি। একইভাবে, ওদিকে ক্যামেরা'র উদ্ভাবণ হল, আর চিত্রশিল্পী'রাও হয়ে গেলেন অনেকটা মুক্ত। বাস্তব দৃশ্য তো ছবি তুলেই ধরে রাখা যাচ্ছে, শিল্পী'রা তাই রং চড়াতে লাগলেন নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে। শুধু বাস্তবের রং না, সাথে মিশল অনুভূতির রং। অনুভূতি প্রকাশ করতে কারও ছবিতে আকাশের রং হল লাল, মানুষের মুখ বেগুনী..."
"আচ্ছা, কবিতার সাথে তুলনা'টা হয়তো একটু বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু ছবিতে তো বোঝার মত কিছুই থাকে না। শুধু এলোমেলো রেখা আর রং..."
"পাপা, ঐ রেখা আর রঙেই শিল্পী হয়তো তার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইছেন..."
"এ কেমন অনুভূতি'র প্রকাশ, যেখানে কিছুই বোঝা যায় না?"
"আচ্ছা পাপা, শোনো", তানি শান্তভাবে হেসে বলল, "মনে করো, একজন বায়োলজিস্ট যখন সাইটোপ্লাজম-ক্রোমোজম নিয়ে কথা বলেন, তখন উনি কিন্তু এই তোমার আমার শরীরের কিছু অংশ নিয়েই কথা বলেন। ওসব আমরা বাইরে থেকে খালি চোখে দেখতে পাই না, আর বায়োলজিস্ট দেখেন ভেতর থেকে। ঠিক তেমনি, একজন শিল্পীও যখন রং ছড়িয়ে ক্যানভাস সাজান, তখন উনিও এই তোমার আমার অনুভূতিগুলোই আঁকতে থাকেন। ওসবও আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই না, কিন্তু শিল্পী দেখার চেষ্টা করেন ভেতর থেকে !"
"হুমম", ওয়াদুদ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
"কী বুঝলে, পাপা?"
"আর্ট নিয়ে তেমন কিছু বুঝিনি। তবে এটা বুঝতে পারলাম, আর্ট সম্পর্কে কিছু বোঝার চেষ্টা না করেই এতদিন আর্ট নিয়ে আজেবাজে ধারণা নিয়ে ছিলাম"
"টেনশান করো না, পাপা। তোমার দলই ভারী", তানি হেসে চায়ে চুমুক দিল, "এবার বলো, আর্ট নিয়ে কী গল্প বলবে বলছিলে?"
"হ্যাঁ তানি। এবারের কেসটা খুবই মিস্টিরিয়াস। আসলে, ডিটেকটিভ বইয়ের বাইরে বাস্তবে এ ধরণের কিছু হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল না।"
"তাই নাকি?", তানি আগ্রহে সোজা হয়ে বসল, "কাহিনী কী, বলো তো?"
"তোকে বলছি, কারণ এই কেসে এখন পুলিশও রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এখন আসলে পুলিশের আর কিছু করারও নেই। শুধু মাথা খাটানো ছাড়া। আর তোর অ্যানালাইসিস পাওয়ার ভালো। দেখি তোর সাথে কথা বলে যদি মাথায় কোনও আইডিয়া আসে..."
"পাপা ! ভুমিকা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ! গল্প শুরু করো !"
"আচ্ছা, শোন তাহলে", ওয়াদুদ সোফায় হেলান দিয়ে বলতে শুরু করলেন, আর তানি গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজনায় সোফা থেকে উঠে ওয়াদুদের সামনে কার্পেটের উপর গিয়ে বসল।
"লোকটার নাম ছিল সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। পরিচিতদের কাছে সমর সেন। বেশ বড় ঘরের ছেলে - অর্থবিত্তের অভাব ছিল না। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে ইওরোপে পাড়ি জমান, সেও প্রায় আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা", ওয়াদুদ চায়ে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলেন, "ইওরোপে এ-শহর ও-শহর ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত থিতু হলেন ফ্রান্সে, পারী'র কাছাকাছি কোথাও। লোকটার ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল ভালই, অল্পদিনেই ভাল উন্নতি করতে শুরু করলেন। যতদিন ছিলেন, নিজের ধন-সম্পদ বাড়িয়েই গেছেন। বিয়ে-থা'ও করেন নি; সো, নো উত্তরাধিকার। আর ভদ্রলোক ছিলেন আর্টের ভাল সমঝদার। শেষ দিকটায় আর্ট কালেকটর হয়ে উঠেছিলেন। তার অগাধ সম্পত্তি খরচ করে মাঝে-মাঝেই নিলামে বেশ দামি-দামি পেইন্টিংস কিনে নিতেন..."
খালি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ওয়াদুদ বলতে থাকেন, "শেষ বয়সে সমর সেন দেশে ফিরে আসেন। শহর থেকে দূরে পাহাড়ী এলাকায় নিজের একটা বাংলো করেন। গিয়েছিলাম এই কেস-এর কারণে - আসলেই চমৎকার লোকেশান। লোকটার রুচি'র তারিফ করতে হয়। সমর সেন নিজেও অল্প-বিস্তর ছবি আঁকতেন, বাংলোতে তার নিজের একটা স্টুডিও আর পার্সোনাল আর্ট গ্যালারী ছিল। তো এই সমর সেন, প্রায় মাস ছয়েক আগে তার উইল তৈরি করেন। গল্প-উপন্যাসের বড়লোকদের মতই তিনি তার বাংলো'টা দিয়ে যান একটা অনাথ আশ্রমকে, অস্থাবর সব সম্পত্তি লিখে দেন তার তার একমাত্র ভাইপো নীল, মানে নীলেন্দ্র সেন'কে; আর তার কাছে ছিল ছয়টা অমূল্য পেইন্টিংস - যেগুলো তিনি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।"
ওয়াদুদ অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে একটু বিরতি নিলেন।
"তারপর?", তানি তাড়া দিল।
"এখন পর্যন্ত কাহিনী'র সবটা ভালই। সমস্যা শুরু হল, যখন থেকে সমর সেন বুঝতে পারলেন তার ভাইপো নীল ছবিগুলোও হাতিয়ে নিতে চায়। ছবিগুলোর ছিল আকাশছোঁয়া দাম। আমি শুধু একটা ছবি'র রশিদ দেখেছিলাম, তিনি নিলামে কিনেছিলেন প্রায় চার লাখ ইউরো দিয়ে !"
"মাই গড ! কার আঁকা ছবি ছিল?"
"শিল্পী'র নাম আমার মনে নেই, মা। ওসব নিয়ে আমার কোনওকালে আগ্রহও ছিল না। কিছু অবোধ্য ছবি'র এত দাম কেন হয় সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকত না..."
"আচ্ছা, তুমি গল্প'টা বলো না?"
"হুম, তিনি ক'মাস আগে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু বুঝতেই পারছিস, এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গিফটের মত প্যাকেট করে নিয়ে গেলাম আর মিউজিয়ামে দিয়ে আসলাম - ব্যাপারটা এত সোজা না। তার আগে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকেও দেখতে হবে ছবিটা অরিজিনাল কি না, বৈধভাবে কেনা হয়েছে কিনা, আরও অনেক ফর্মালিটিস... কিন্তু সমরবাবু বুঝতে পারছিলেন, তার যা করার খুব দ্রুত করতে হবে; নীল তাকে এতটা সময় দেবে না। এবং হলোও তাই..."
"কী হলো?"
"এক রাতে হঠাৎ বাংলোতে ডাকাত পড়লো। চাকরদের জবানিতে বোঝা গেল, ডাকাতেরা মূলত ওই ছবি কেড়ে নিতেই এসেছিল, কারণ অন্য সবকিছু লুটপাট করার পরও ডাকাতের দল অনেক দীর্ঘ সময় ধরে তার আর্ট গ্যালারী তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু ওখানেই ম্যাজিক ! ছয়টা ছবি'র একটাও ওখানে ছিল না ! ডাকাতেরা পুরো বাড়ি ছারখার করল, কোথাও নেই ছবিগুলো ! একদম ভ্যানিশ ! শেষে যাওয়ার সময় ডাকাতেরা সমরবাবু'র মাথায় গুরুতর আঘাত করে গেল।" ওয়াদুদ একটু থেমে বললেন, "সমর সেন সেই যে পড়লেন, তার আর জেগে ওঠা হয়নি। প্রায় সপ্তাহ-তিনেক কোমায় থাকার পর গত সোমবারে তিনি মারা যান। নীলের কাজ ছিল খুবই কাঁচা হাতের। ঐ ডাকাতদের মাঝে দুইজন পরের সপ্তাহেই ধরা পড়ে। আর তাদের স্বীকারোক্তিতে নীল'ও এখন জেল-এ"
"আর ছবিগুলো?"
"গায়েব। একদম বাতাসে মিলিয়ে গেছে। তার বাংলো'র সবকটা ঘর, সম্ভাব্য সব জায়গা দেখা হয়েছে। সমর সেনের বন্ধু-বান্ধব তেমন কেউ ছিল না দেশে। অন্তত এমন বিশ্বস্ত কেউ ছিল না, যার কাছে তিনি কোটি কোটি টাকা দামের ছবিগুলো রেখে যাবেন।"
"চাকরেরা সরায় নি তো?"
"চাকরেরা ছিল সবাই পাহাড়ি চাষা-ভুষা'র দল। এসব ছবি'র মর্ম বা মূল্য বোঝার সাধ্য ওদের নেই।"
"হুমম... তাহলে? একদম কোনও ক্লু নেই?"
"ওখানেই তো মজা !", ওয়াদুদ রহস্যের হাসি হাসলেন, "ঐ যে বললাম, সমরবাবু আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন নীল ছবিগুলো বাগিয়ে নিতে চাইবে, তাই তিনি নিজেই ঐ ছয়টা ছবি লুকিয়ে গিয়েছিলেন। আর এর ক্লু রেখে গেছেন তার নিজের আঁকা একটা ছবির পেছনে..."
"কেমন ক্লু?", তানিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল।
"বলছি শোন। আমরা ছবিগুলো'র ব্যাপারে জানতে পেরেছি তার উইল থেকে। তল্লাশী'র জন্যে যখন বাংলোয় গেলাম, দেশি পুরো আর্ট গ্যালারী খালি। অন্য কোনও রুমেও তো ছবিগুলো পেলাম না। শুধু তার স্টুডিওতে দেখলাম, বোর্ডের সাথে একটা ছবি লাগানো। বোঝা যাচ্ছিল সেটা ওখানে বসেই আঁকা। দোতলার ঐ স্টুডিও'র বিশাল জানালা দিয়ে বাইরের যে দৃশ্যটা দেখা যায়, ছবিটা ঐ দৃশ্যটারই ল্যান্ডস্কেপ। তা সবশেষে ঐ ছবিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, ছবি'র উল্টোপিঠে ছোট একটা কবিতা'র মত কয়েকটা লাইন। লাইনগুলো ভালরকম জটিল, অর্থ এখনও উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু এটা মোটামুটি কনফার্ম যে, লাইনগুলো ঐ ছয়টা ছবি'র লোকেশন ইঙ্গিত করেই লেখা..."
"কিভাবে কনফার্ম হলে?"
"পুরোপুরি কনফার্ম বলিনি, মোটামুটি।", ওয়াদুদ পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করলেন, "আমি লাইনগুলো লিখে এনেছি। পড়ে দেখ, তোরও তা-ই মনে হবে।"
তানিয়া কাগজটা রীতিমত কেড়ে নিয়ে পড়তে শুরু করল~

ছয়টা তারা নিদ্রারত
আজ অদিতি'র বক্ষে নত
দীর্ঘতম সৌরদিনে
দেখবে কেমন চমকপ্রদ -
কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া,
নিখুঁত এবং বিস্তারিত,
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত

ওয়াদুদ বিড়বিড় করতে লাগলেন, "আজকালকার লোকগুলো মারা যাওয়ার আগে এমন সব ক্লু রেখে যাচ্ছে... এরা কি মনে করছে, বাংলাদেশে শার্লক হোমস এসে বসে আছে ওদের জন্যে?..."
তানিয়া বাবা'র কথা শুনতে পায়নি। তার চোখ চকচক করছে। সে মুখ তুলে সরাসরি প্রশ্ন করল, "পাপা, ছবিটা এখন কোথায়?"
"আমার অফিসে..."
"আমি কাল ছবি'টা দেখতে যাব !"
ওয়াদুদ ইতস্তত করতে লাগলেন। তানিয়া তার হাত ধরে অস্থির গলায় বলে উঠল, "কী হল পাপা, প্লিজ? দেখো, সমর সেন বেঁচে নেই। ডাকাতেরা সব হাজতে। নীলেন্দ্রও ধরা পরেছে। ছবিগুলা'র কথা হয়তো আর কেউ জানেও না এখানে। পত্রিকায় বলা হয়েছে?"
"না, পেপারে শুধু ডাকাতি'র খবর আর ডেথ নিউজ'টা গেছে। ছবিগুলো'র নিরাপত্তার জন্যেই ওসবের কথা মিডিয়ায় বলা হয়নি। আমরাই খুঁজে দেখছি !"
"গুড ! তাহলে দেখো, ফিল্ডে আর কেউ নেই ! এটা একটা সেফ ট্রেজার হান্ট ! প্লিজ পাপা, প্লিজ..."
ওয়াদুদ বেশ খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, "আচ্ছা, তোকে কাল আমার অফিসে নিয়ে ছবি'টা দেখাবো। বাট স্পটে নিয়ে যেতে পারবো না। তানি, তোকে নিয়ে আমি কোনও রিস্ক নিতে রাজি না..."
"আচ্ছা বাবা আচ্ছা !", তানি খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে তারপর ছুটে রুমে চলে গেল। কাগজটা তখনও তার হাতে ধরা।
সে রাতে তানিয়ার ঘুম হল না।





দুই.

ইনস্পেক্টর ওয়াদুদের টেবিলের উপর সমর সেনের স্টুডিওতে পাওয়া শেষ পেইন্টিং'টা ছড়ানো। ৪০ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ক্যানভাস। তানিয়া ঝুঁকে পড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মুখ তুলে বলল, "ছবির নিচে দুজনের সিগনেচার দেখছি ! সমর সেন, আর রাতুল শাহ। এই রাতুল শাহ'টা কে?"
"চারুকলা'র ছাত্র। সমর সেনের ফোনবুক থেকে নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। সমরবাবু'র খুব পরিচিত কেউ না। ডাকাতির মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাতুল'কে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ছবিটা আঁকাতে। তবে রাতুল ছবিটা শেষ করে আসতে পারে নি, সমরবাবু তাকে অত সময় দেন নি। সে যতক্ষণ আঁকছিল, সমর বাবু নাকি প্রায় পুরো সময়টাতেই তাকে তাড়া দিচ্ছিলেন", ওয়াদুদ কাছে এসে ছবিটার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, "এই ছবি দেখার পর রাতুল বলছে, সে চলে আসার পরও এই ছবি'র উপর আরও কিছু কাজ করা হয়েছে। সম্ভবত বাকি কাজটা সমর সেন নিজেই করেছেন।"
"বাড়তি কী আঁকা হয়েছে, রাতুল ধরতে পেরেছে?"
ওয়াদুদ খানিকটা তৃপ্তি আর প্রশংসা'র দৃষ্টিতে তাকালেন, এই মেয়ে'র প্রশ্নগুলো খুব শার্প হয়। তবে জবাবটা মোটামুটি হতাশার।
"সমর সেন নিজে থেকে বাড়তি কিছুই আঁকেন নি। রাতুলই মোটামুটি ছবিটা এঁকে দিয়ে এসেছিল। সমরবাবু শেষে শুধু কিছু আলো-ছায়া'র ইফেক্ট দিয়েছেন।"
"আলো-ছায়া'র ইফেক্টও কিন্তু বেশ পাকা হাতের কাজ বলে মনে হচ্ছে..."
"রাতুলও সেটা স্বীকার করেছে। সমরবাবু অন্তত আনাড়ি শিল্পী ছিলেন না।"
"এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে?", তানিয়া বিড়বিড় করতে লাগল, "গ্যালারি আর স্টুডিও থেকে সব ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন, শুধু এটা ছিল। হয়তো শেষ দিন পর্যন্ত এটা নিয়ে কাজ করছিলেন, তাই না পাপা?"
"হতেই পারে।"
"ভদ্রলোকের বয়স ছিল আশি'র ওপর। বুঝতে পারছিলেন হাতে সময় ছিল কম। এই সময়ে তিনি একটা সপ্তাহ ধরে এই ছবি নিয়ে মেতে ছিলেন... অথচ ছবিতে বলার মত প্রায় কিছুই নেই ! সামনের গাছগাছালি, কয়েকটা টিলা, কী ক্লু রেখে গেলেন এটা?"
"ইয়াং লেডী", ওয়াদুদ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, " ক্লু'টা ক্যানভাসের এই পাশে না, অপর পাশে। ছবিতে না, ছড়ায়।"
"রাইট", তানি ছবিটা ওল্টালো। মোটামুটি পরিস্কার হাতের লেখা। সম্ভবত 2B পেন্সিল দিয়ে লেখা হয়েছে। সেই অদ্ভূত আট'টা লাইন:

ছয়টা তারা নিদ্রারত
আজ অদিতি'র বক্ষে নত
দীর্ঘতম সৌরদিনে
দেখবে কেমন চমকপ্রদ -
কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া,
নিখুঁত এবং বিস্তারিত,
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত

ছয়টা তারা বলতে নিশ্চয়ই ছয়টা ছবি, ছবিগুলো এখন ঘুমিয়ে আছে। অদিতি'র বুকে। অদিতি'টা কে? তানি মুখ তুলতেই ওয়াদুদ বুঝে নিয়ে জবাব দিলেন, "অদিতি নামে কারও হদিশ মেলেনি। ওটাই প্রথম সূত্র ধরে ট্রাই করা হয়েছিল"
তানি আবার চোখ নামালো, ঠিকই তো। নিশ্চয়ই অদিতি নামে কাওকে পাওয়া যাওয়ার কথা না। নিশ্চয়ই এত জটিল একটা ধাঁধাঁ'য় এত সহজে একটা নাম তুলে দিয়ে যান নি সমর সেন। এত রহস্য করে ক্লু'টা তিনি লিখেছেন যাতে নীল বা নীলের মত কেউ ধরতে না পারে। অদিতি নামে পরিচিত কারও নামই যদি তুলে দিতেন, তাহলে এটা পাওয়ার পর নীল তো প্রথমেই ঐ অদিতি'কে হামলা করে বসতো। অদিতি কারও নাম না। তাহলে প্রশ্ন'টা হবে, 'অদিতি কী?'
পরের লাইনটা প্রথম দুই লাইন থেকে খাপছাড়া, তবে এখন পর্যন্ত এই লাইনটাই হয়তো বোঝা যাচ্ছে - "দীর্ঘতম সৌরদিনে", সৌরবছরের দীর্ঘতম দিন। জুনের ২১ তারিখ। এই ছবি আঁকার কাছাকাছি সময়ের একটা দিন। ওই দিনটায় চমকপ্রদ কিছু হয়েছিল ! ওইদিন তিনি ছবিগুলো সরিয়েছিলেন? অদিতি'র বুকে রেখে এসেছিলেন? হতে পারে। তানি আবার মুখ তুলল,
"পাপা, জুনের ২১ তারিখ সমর সেন ঠিক কী কী করেছিলেন, সে বিষয়ে কিছু জানা গেছে?"
ওয়াদুদ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে বললেন, "দীর্ঘতম সৌরদিনে? না, চমকপ্রদ কিছু জানা যায় নি। বাংলোতেই ছিলেন, এরিয়া'র বাইরে কোথাও যান নি। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে শোনা। প্রতিদিনের মত সারা সকাল স্টুডিওতে ছবি আঁকা, দুপুরের পর একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি, সন্ধ্যার পর থেকে আবার বাংলো'তে। ডেইলি রুটিন।"
আচ্ছা লোক তো ! এমন একঘেঁয়ে জীবনযাপন করতে করতে যাওয়ার আগে এমন মারাত্মক একটা ধাঁধাঁ রেখে গেল ! তানি পরের লাইনে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ওয়াদুদ বলে উঠলেন, "আর হ্যাঁ, বাংলো'র ত্রিসীমানায় কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছের সন্ধান মেলে নি !"
উফফ ! এর মানে কী ! ধাঁধাঁয় যা যা লেখা হয়েছে তার কোনওটারই বাস্তব অস্তিত্ব নেই !
"পাপা?", তানি খানিক বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "তাহলে কি এমন হতে পারে এটা শুধুই একটা ধাঁধাঁ? যাস্ট ফর ফান?"
"হতেই পারে", ওয়াদুদ উঠে দাঁড়ালেন, "কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, ওই ছয়টা মহামূল্যবান ছবি তাহলে গেল কোথায়?"
"হুমম, এটা একটা ধাঁধাঁ-ই। ভয়াবহ জটিল একটা ধাঁধাঁ।" তানি মাথা নাড়ল।
ওয়াদুদ এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন, "তানি চল, এখন বাসায় যাই। আজ অনেক হল।"
"পাপা, ছবিটার একটা কপি কি আমি নিতে পারব?"
"এত বড় ছবি এই মুহুর্তে কপি করা তো ঝামেলা'র ব্যাপার। তুই বরং আপাতত তোর ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে যা, পিসিতে দেখতে পারবি। মন্দের ভাল যা হয়।"
তানি তাই করল। এই ছবি না নিলে রাতে তার ঘুম হবে না।
এতটা থ্রিলিং একটা ট্রেজার হান্ট বাস্তবে হচ্ছে এটা তানি'র এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ! আর একাজ সে করছে একা ! একা !! হোমসের ওয়াটসন ছিল, ফেলুদা'র ছিল তোপসে। তার সাথে কে আছে? তূর্য? ধুর, তূর্য'র বুদ্ধি-শুদ্ধির ব্যাপারে এখনও ভাল রকম সন্দেহ আছে। তবু কথা শোনার জন্যে হলেও একজনকে লাগে। পাপা তো সবসময় এরকম সময় দিতে পারে না ! কাল ছুটির দিন। সকাল সকাল তূর্য'কে নিয়ে বসতে হবে। উত্তেজনায় তানি সকালের অপেক্ষায় রাত পোহাতে লাগল !



তিন.

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর থেকে তানিয়া ছটফট করতে লাগল। লাইনগুলো মাথা থেকে সরছে না। ফেসবুক খুলে একটা মেসেজ লিখে পাঠালো - "শাহেদ ভাই, 'অদিতি' শব্দের মানে জানো? আর্জেন্ট"। মেসেজ পাঠানোর পর পরই তানি'র মনে হল, কাজটা একদম অনর্থক করা হল। শাহেদ ভাই নিশ্চয়ই এই মেসেজ চেক করবে দুই-তিন সপ্তাহ পর। সে ব্লগে আর ফেসবুকে নিয়মিতভাবে অনিয়মিত। (শাহেদ খান এই মেসেজের জবাব দিয়েছিল সতের দিন পর। দুই অক্ষরের জবাবটা ছিল "জানি না")
ঘরে একটা বাংলা ডিকশনারী না থাকাতে তানি'র এখন আফসোসের সীমা রইল না। সে পিসিতে পেইন্টিং'টা খুলে আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছয়টা তারা... আকাশের সিক্স সিস্টার্স বা কৃত্তিকা-মন্ডলের কিছু কি? না, ছয়টা তারা হয়তো যাস্ট এই ছয়টা পেইন্টিং-ই। তারা'র মত জ্বলজ্বলে ক্যানভাস। এত দামি সব ছবি - কার কার পেইন্টিং আছে ওখানে? ফ্রান্স থেকে কেনা, ইম্প্রেশানিস্ট'দের কারও ছবি থাকা কি খুব অস্বাভাবিক? ক্লদ মনে'? রেনোয়া? তানি'র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।
সে আবার কাগজটা বের করল:

কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া
নিখুঁত এবং বিস্তারিত
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত

বাংলো'র কম্পাউন্ডে কোথাও কৃষ্ণচূড়া গাছ নেই। ছবিতে কোথাও কি কৃষ্ণচূড়া আঁকা হয়েছে? তানি আবার খুঁটিয়ে দেখল - না; কোথায় কী! অথচ বলা হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া'র দীর্ঘ ছায়া সময় পেলেই ওদের এসে জড়িয়ে নিত। গাছের আবার সময়ের কী অভাব। তাহলে 'সময়' দিয়ে কী বোঝাচ্ছে - একটা নির্দিষ্ট সময়েই গাছটার ছায়া ওদের এসে জড়িয়ে নিত? মানে কী ! পেইন্টিংসগুলো নিশ্চয়ই গাছতলে ফেলে আসেন নি। ঠিক তখনই তানি'র মাথায় খেলে গেল, বনের মাঝে কোথাও কোনও কটেজ নেই তো ! হয়তো বাংলো'র সাথে লাগোয়া না ! তাই পুলিশের খেয়ালে আসে নি ! একটা কটেজ বা রুম, কোনও একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশে - তানি অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগল। জায়গাটায় যদি একবার যাওয়া যেত ! উফফ, এভাবে কী হয়? তাও আবার একা ! পাশে একটা কেউ থাকলেও কথায় কথায় হয়তো অনেক নতুন কিছু বের হয়ে আসতো। রাত হয়ে গেছে অলরেডী, পাপা নিশ্চয়ই ঘুম।
আগের রাতেও ভালমত ঘুমায়নি, তাই তানি'রও আস্তে আস্তে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে লাগল।

রাত প্রায় দুইটা পঁয়তাল্লিশের দিকে তানি ছুটে পাপা'র দরজায় জোরে আঘাত করতে লাগল ! "পাপা ! ওঠো ! পাপা !"
ওয়াদুদ ঘুম ভেঙে হতচকিত অবস্থায় ছুটে এলেন, "কি রে ! কী হলো?"
"পাপা, অদিতি মানে পৃথিবী ! দি আর্থ !"
"কী?", ওয়াদুদ চোখ কচলে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলেন, "কী হচ্ছে এখানে?"
"তোমার ওই ছবি'র ধাঁধাঁ ! অদিতি'র বুকে মানে পৃথিবী'র বুকে লুকানো !"
ওয়াদুদের ধাতস্থ হতে সময় লাগল। তানি চিরকালই শান্ত মেয়ে, তাকে এতটা অস্থির দেখে ওয়াদুদও অভ্যস্ত না। একটু সময় নিয়ে বললেন, "কী বলছিস, বুঝতে পারছি না। সবটা আবার বল তো?"
"শোনো, 'অদিতি'র একাধিক মিনিং আছে। রানা ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম। তার মাঝে একটা অর্থ হচ্ছে - পৃথিবী"
"রানা ভাইটা কে? সে এত রাতে এখানে কী করে?"
"উফফ পাপা ! গীতিকার রানা ভাই, দলছুটের গান লেখে। লোকটা শব্দ-শিল্পী। উনার ব্লগ থেকে জানলাম। আচ্ছা, এখন শোনো। ছবিগুলো অদিতি'র বুকে মানে মাটির বুকে লুকানো !"
ওয়াদুদ ঘড়ির দিকে তাকালেন, "কাল সকালে উঠতে হবে না?"
"না, কাল শুক্রবার ! তোমার এই অবস্থায় ঘুম আসছে কী করে?"
"আচ্ছা ঠিকাছে", ওয়াদুদ হাসলেন, "এখন বল, লোকটা পেইন্টিংগুলো মাটিতে পুঁতে রাখতে যাবে কেন? এ তো মধ্যযুগীয় স্টাইলে গুপ্তধন রাখা। ডাজ ইট মেক সেন্স? শহরে কোনও সেফটি ভল্টে রাখলেই পারতো।"
"এটাও ভেবেছি। ভুলে যাচ্ছো, উনি থাকতেন শহর থেকে অনেক দূরে পাহাড়ী এলাকায়। শেষ দিকটায় নীল'কে সন্দেহ করতে শুরু করছিলেন। তাই হয়তো ছবিগুলো গাড়ি করে এতদূর আনার রিস্ক নিতে চান নি। কারণ নীল যদি টের পেয়ে যেত, পাহাড়ী নির্জন পথে ওই গাড়ি লুট করা হতো ওয়ান-টু'র ব্যাপার। তাই বাংলো'র আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে রাখলেন পেইন্টিংসগুলো"
"হুম, সো ইন এ ওয়ে, ইট মেক সেন্স"
"যাস্ট ইন আ ওয়ে, বাট আরেকটা ওয়ে থাকতে পারে। ঐ এলাকায় আশেপাশের বনে কোনও কটেজ আছে কি না বলতে পারো? যেখানে কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছও থাকতে পারে?"
"তাই তো ! কৃষ্ণচূড়া তো ক্লু-তে ছিল ! লোকটা দেখি ডেন্জারাস ক্লু রেখে গেছে !"
"হুমম", একটু থেমে তানি বলল, "তবে, 'অদিতি'র মিনিং জানার পর থেকে কটেজ'এর কথা আর ভাবছি না। বরং এটা কৃষ্ণচূড়া গাছের আশেপাশে কোথাও মাটিতে পুঁতে রাখা !"
"শাবাশ তানি ! দুই রাতে তুই অনেকদূর সলভ করে ফেলেছিস ! এখন ঘুমাতে যা। কাল সকাল-সকাল তোর সাথে এটা নিয়ে বসব। প্রমিজ", ওয়াদুদ হেসে তাকালেন।
"এসব ধাঁধাঁ'র সমস্যা কি জানো?", তানি চোখ তুলে তাকালো, "কনফিউজ করার জন্যে এর একাধিক মিনিং থাকতে পারে। হয়তো আমরা পুরো উল্টো পথে আগাচ্ছি ! হয়তো !"
"ডোন্ট ও'রি", ওয়াদুদ এসে তানি'র মাথায় হাত রাখলেন, "উল্টো পথটা যদি ঠিকমত আবিষ্কার করতে পারিস, সোজা পথ খুঁজে পেতেও তোর সময় লাগবে না। দেখবি।"
তানি হালকা হেসে রুমে চলে গেল।
আজ তার মোটামুটি গভীর ঘুম হল।




চার.

তূর্য প্রথমে পিসি স্ক্রীনে ছবিটার দিকে তাকালো, তারপর হাতের কাগজটা একবার দেখল, এরপর মুখ তুলল তানি'র দিকে, "কী মারাত্মক গল্প শোনালে তানি'পু ! এই সব রিয়েলি হচ্ছে ! ওয়াও !"
"এবার তুই কী ভাবছিস সেটা বল"
"আমি ভাবার সময় পেলাম কোথায়? মাত্র তো গল্পটা শুনলাম !"
"হুম", তানি মাথা নাড়ল, "আমি এখন আবার শুরু থেকে প্রতিটা লাইন ধরে আগাচ্ছি। ছয়টা তারা এসে পৃথিবী'র বুকে লুকালো, মানে পেইন্টিংসগুলো; চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটল জুনের ২০-২১ তারিখের দিকে। তখন কোনও এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়া খুব নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট একটা সময়ে ওদের এসে জড়িয়ে রাখল"
"সময়টা কিভাবে জানবি?", ওয়াদুদ হাতে করে বড় বাটিতে সরষে তেল আর পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে এনেছেন। চুলায় চায়ের পানি বসানো।
তানি মুখ তুলল, "সেটাই। উনি বলছেন - 'যখন সময় পাই - তখনই'। এখানে একটা গন্ডগোল আছে। উনি কথাটা বলেছেন ফার্স্ট পার্সনে - 'যখন সময় পাই'। যদি গাছটার সময় পাওয়ার ব্যাপারে বলতেন, তাহলে বলা উচিৎ ছিল -'যখন সময় পায়'। তা না করে নিজের সময় পাওয়ার কথা বললেন। সবটা আবার এলোমেলো লাগছে"
"তুমি এখানেও গ্রামার ভুল ধরবা? 'পায়' লিখতে গিয়ে 'পাই' লিখে ফেলসে হয়তো"
"তূর্য শোন, এটা আমাদের একমাত্র ক্লু ! এটা নির্ভুল ধরেই আপাতত আগাতে হবে। প্রতিটা শব্দই ইম্পর্ট্যান্ট"
"তাই বলে একটা 'পাই' আর 'পায়' নিয়ে এতটা ভাবতে হবে? আমার তো মনে হয় না এই 'পাই-পায়' নিয়ে এত ভাবার কিছু আছে"
ওয়াদুদ সেই মুহুর্তে চা-র ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকলেন, "কী সব পাই-পাই করছিস ! কী পাচ্ছিস এত? আচ্ছা, তোদের পাই-পাই শুনে মনে পড়ল। 'লাইফ অফ পাই' মুভিটা চলছে হল-এ। থ্রি-ডি ! ইভনিং শো-তে কে কে যেতে রাজি?"
তূর্য একগাল হেসে হাত তুলল। দুজনই তানিয়ার দিকে তাকাল। তানি স্থানুর মত স্থির হয়ে আছে ! চোখের পাতা'ও নড়ছে না !
ওয়াদুদ হাসি থামিয়ে বললেন, "কীরে তানি, কেস সলভ না করা পর্যন্ত আমরা মুভিও দেখতে পারবো না?"
"পাপা !", তানি ফিসফিস করে বলে উঠল, "ইটস পাই !"
"মানে?"
"পাই, মানে পাওয়ার কথা বলা হয়নি। তুমি এইমাত্র যেমনটা বললে -'পাই' শুনে তোমার 'লাইফ অফ পাই' মনে পড়ল ! আসলে 'পাই' একটা আলাদা শব্দ। এর নিজেরই একটা ভ্যালু আছে !"
তূর্য আস্তে আস্তে বলল, "থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফোর?"
"ইয়েস ইয়েস !", তানি প্রায় চিৎকার করে উঠল, "সময় যখন পাই ! ইউ নো, মার্চের ১৪ তারিখ'কে পাই-দিবস বলা হয়। ৩টা ১৪ মিনিট : পাই-সময়। সময় যখন পাই - মানে সময় যখন সোয়া তিন'টার মত ! ঐ সময়ের ছায়া ফলো করতে হবে ! জুনের ২১ তারিখ সোয়া তিনটার সময়ের একটা নির্দিষ্ট ছায়া !"
ওয়াদুদ আর তূর্য দুজনেরই হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগল। ওয়াদুদই খানিক পর নীরবতা ভাঙলেন, "জানি না, তুই যেটা বলছিস সেটাই এই ধাঁধাঁ'র মিনিং কি না। তবে যদি সত্যি এটাই হয়, তাহলে এটা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট পাজল। আর তুই আমার দেখা সবচেয়ে ইনটেলিজেন্ট মানুষ !"
ওসব কোনও কথা তানি'র কানে যায়নি। সে বিড়বিড় করে বলে চলেছে, "আমি জানতাম, এখানে সময়টাও লেখা আছে। আমি জানতাম... এত মারাত্মক একটা ধাঁধাঁয় বানান ভুল করে 'পাই' লেখার প্রশ্নই আসে না ! এত অল্প কয়েকটা লাইনে কোনও ভুল থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করিনি।"
বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা'র পর তূর্য বললো, "তাহলে কৃষ্ণ আর চূড়া'র মাঝে দেয়া হাইফেন-টাও নিশ্চয়ই ভুল করে দেয়া হয়নি। ওটারও নিশ্চয় মিনিং আছে?"
"কী বললি তুই?", তানি তূর্যের হাত থেকে কাগজটা প্রায় কেড়ে নিল।
তূর্য আমতা আমতা করে বলল, "আরে আমি তো এমনি বললাম। মাঝখানে হাইফেন দিয়ে তো কেউ কৃষ্ণচূড়া লেখে না..."
"গুড!", তাকে থামিয়ে দিয়ে তানি সোজা ওয়াদুদের দিকে তাকাল, "পাপা, এই পিসি স্ক্রীনে দেখে হবে না। আসল ছবিটা আবার দেখতে হবে। তোমার অফিসে চলো।"
ওয়াদুদ এক সেকেন্ড থেমে বললেন, "ওকে চল।"
তার ধারণা, তানি রহস্যটার সমাধানের কাছাকাছি চলে গেছে। এখন 'না' বলার প্রশ্নই আসে না।




পাঁচ.

ইনস্পেক্টর ওয়াদুদের টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে সমর সেনের শেষ পেইন্টিংসটা দেখছিল ওরা। ওয়াদুদ, তানি, তূর্য। সাব-ইনস্পেক্টর তারেকও ছিল আশেপাশে। এদের কথা শুনে আগ্রহী হয়ে এখন সেও এসে জুটেছে। সবাই ছবিটাতে কিছু খুঁজছে, কিন্তু ঠিক কী যে খুঁজতে হবে এই বিষয়ে কেউই আসলে নিশ্চিত না।
অনেকক্ষণ নীরবতার পর তানি আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, "সমর সেন শেষদিন পর্যন্ত এই পেইন্টিংস'টাকেই গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন সময় অল্প। হয়তো তার ধারণা ছিল নিজে এঁকে শেষ করতে পারবেন না। তাই চারুকলার এক শিল্পীকে দিয়ে তাড়াহুড়া করে ছবিটা আঁকিয়ে নিয়েছেন। পরে তিনি ডিটেইলসের কাজ করেছেন..."
তূর্য বলে উঠল, "কিন্তু সময় তো ছিল ! উনি এটা আঁকার জন্যে পরে আরও এক সপ্তাহ সময় পেয়েছেন..."
"আরে?", তানিয়া বিরক্ত চোখে তাকাল, "উনি কি জানতেন নাকি কোনদিন ডাকাত পড়বে? যেদিন রাতুল ছবিটা এঁকে এসেছিল ওই রাতেও তো ডাকাত-হামলা হতে পারত !" তূর্য চুপ হয়ে গেল, তানিয়া একটু শান্ত হয়ে বলতে থাকল, "শেষদিকে পুরো সময়টাতেই সমর সেন ঝুঁকি'র মধ্যে ছিলেন। এর মাঝে পেইন্টিংসটা শেষ করলেন। আর আরও ইম্পরট্যান্ট হল, উনি তারপর আলো-ছায়া নিয়ে আরও ডিটেইলস কাজ করলেন।"
সাব-ইনস্পেক্টর তারেক ওদের সকালের আলোচনার কথা জানেনা। সে অবাক বিস্ময়ে তানিয়ার কথা শুনতে লাগল। তানি বলে গেল, "কিন্তু ছবিটা এত সিম্পল, এখানে বিশেষ কোনও ছায়াই তো ধরতে পারছি না... কৃষ্ণ আর চূড়া আলাদা করে লেখার মানে টা কী? পাপা? কৃষ্ণ নামে কোনও গাছ আছে?"
"আমার জানা মতে নেই", ওয়াদুদ বললেন। তারেকও মাথা নাড়ল।
"অথবা... অথবা", তানি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, "ওনার কাছে কৃষ্ণ নামে কোনও ভাস্কর্য ছিল? আর্ট কালেকটর ছিলেন, ভাস্কর্যও তো জমাতে পারেন... লম্বা কোনও মূর্তি যেটা হয়তো এই ছবিতে নেই..."
ওয়াদুদ একটু দ্বিধায় বললেন, "এই ছবি'র বাইরের কোনও কিছুর ছায়া যদি বোঝাবেন, তাহলে এই ছবির গুরুত্বটা কী?"
"হয়তো ছবিটা যাস্ট একটা ক্যামোফ্লাজ; হয়তো এটা কোনও ক্লু-ই না, শুধু ছড়াটাই ক্লু ! উফফ পাপা !", তানি টেবিলে মুখ ঢেকে বসে পড়ল, "আমি আর পারছি না..."
ওয়াদুদ আস্তে করে তানি'র মাথায় হাত রাখলেন, "তোকে কেউ জোর করছে না, মা। তুই শান্ত হ।"
"আপনি যতদূর এগিয়েছেন, আর কেউ এতটা ভাবেও নি", ওপাশ থেকে তারেক বলে উঠল।
তানি মাথা নিচু করে রইল, আর অপেক্ষা করতে লাগল তূর্য যেন এখন বোকার মত কিছু একটা প্রশ্ন করে বসে। প্রায় সময়ই তূর্য হঠাৎ হালকা প্রশ্ন করে ওঠে আর তাকে বোঝাতে গিয়ে তানি তখন আবার নতুন করে ভাবতে পারে।
ঠিক ঠিক তূর্যই প্রশ্ন করে উঠল, ছবি'র একদম বামপাশে আঙুল তুলে, "এখানে এটা লম্বা কিসের ছায়া?"
সবাই সেদিকে তাকালো। মাঠের বামপাশে, সবুজ ঘাসের মাঝে সরু আর দীর্ঘ একটা ধুসর অংশ। বাংলো থেকে শুরু করে সরলরেখায় মাঠের এক কোণে চলে গেছে। তানি একবার তাকিয়েই বলল, "ওটা ছায়া না, সম্ভবত পায়ে চলা পথ"
"হুম..."
"অথবা", তারেক মাঝখান থেকে বলে উঠল, "হয়তো ওটা ছায়া-ই..."
"এত লম্বা এটা কিসের ছায়া?", সবাই তারেকের দিকে তাকাল।
তারেক হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "হয়তো বাংলো'র চিমনি'র? স্টুডিও থেকে চিমনি'টা দেখা যাওয়ার কথা না, তবে মাঠের ওপর ছায়া তো দেখা যাবে..."
"চিমনি?", তানি প্রায় চিৎকার করে উঠলো, "বাংলো'তে চিমনি আছে?"
"হুম", তারেক বলে চললো, "লোকটা অদ্ভুত সৌখিন ছিল। একপাশে ফায়ারপ্লেস, আরেক প্রান্তে সুইমিংপুল, কী ছিল না বাংলো'তে?"
"পাপা? চিমনি'র কথা তো আগে বলোনি !"
"ইয়ে মানে, বাংলো'র ডিটেইলস নিয়ে তো কখনও কথা উঠেনি..."
"আচ্ছা, চিমনি'টা কেমন বর্ণনা করতে পারবে?"
ওয়াদুদ তারেকের দিকে তাকাল। তারেক এক সেকেন্ড পরেই বলে উঠল, "তা পারব। তবে বর্ণনা'র চেয়ে ছবি দেখালে বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে..." তারেক তার ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে ছবি এনে দিল।
ছবি'র দিকে তাকিয়ে তানি অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, "দেখতে পাচ্ছো পাপা?"
তূর্য বলল, "হুম, সুন্দর বাংলো"
"বাংলো না গাধা", তানি ধমকে উঠল, "চিমনি'র চূড়া'টা কালো মেটালের। ব্ল্যাক-টপ ! কৃষ্ণ-চূড়া !"
"গুডনেস !", ওয়াদুদ নিঃশ্বাস ফেললেন।
"এখন বুঝতে পারছি কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া", তানি বলে চলল, "উনি ঠিকই নিখুঁত এবং বিস্তারিত এঁকেছেন, কিন্তু চিমনি'টার কথা জানতাম না বলে ওটা যে কোনও কিছু'র ছায়া সেটাই বুঝতে পারিনি আগে !"
"তাহলে এখন?", ওয়াদুদ জানতে চাইলেন, "পুরো ধাঁধাঁটার অর্থ কী দাঁড়ালো?"
"অর্থ দাঁড়ালো - জুনের ২১ তারিখ দুপুর সোয়া তিন'টার দিকে এই চিমনি-চূড়া'র ছায়া ঠিক যেখানে গিয়ে পড়বে - সেখানে কোথাও মাটিতে ছবিগুলো পুঁতে রাখা আছে।"
তারেক চোখ বড় বড় করে এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তূর্য হঠাৎ বলে বসল, "রাত সোয়া তিনটা হতে পারে না?"
"না !", তানি কড়া চোখে তাকালো, "অবশ্যই দুপুর ! রাত তিনটায় তুই ছবির মত এমন ছায়া পাবি কোথায়?"
ওয়াদুদ উঠে দাঁড়ালেন, "তাহলে এত ছায়ার অপেক্ষা করে লাভ কী? মাঠের ওদিকটা পুরো চষে ফেললেই হয়"
"না পাপা !", তানি মাথা নাড়ল, "ছবিগুলো কী অবস্থায় আছে আমরা জানি না। বেকায়দায় খনন করলে নষ্ট হয়ে যাবার চান্সও থাকে। আবার এমন সম্ভাবনাও আছে, হয়তো ছবিগুলো ওখানে নেই। ওখানে গেলে নেক্সট ক্লু'টা পাব শুধু..."
"কী বলিস !"
"যাস্ট বললাম। হতেও পারে। তাই বলছি, সবটা অনর্থক না খুঁড়ে শুধু ছায়াটা যেখানে গিয়ে পড়বে ওখান থেকেই শুরু করা উচিৎ হবে। যেহেতু সূত্রটা - নিখুঁত এবং বিস্তারিত।"
সবটা শোনার পর সবাই মুগ্ধ-বিস্ময়ে খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল।
"শাবাস তানি", ওয়াদুদ পিঠ চাপড়ে দিয়ে নীরবতা ভাঙলেন, "জানিনা এটাই ঠিক উত্তর কিনা। তবে যা দেখালি, সেটাও ক'জন পারতো?"
একটু ইতস্তত করে তারেক প্রশ্ন করল, "আজকে জুলাইয়ের সাতাশ তারিখ। তাহলে ওই 'নিখুঁত এবং বিস্তারিত' লোকেশন'টা পাওয়ার জন্যে আমাদের কী আগামী বছর জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?"
"আমারও একই প্রশ্ন", তূর্যও মাথা নাড়ল।
তানি হালকা হেসে বলল, "না, অফিসার। মাত্র তো মাসখানেক হল। উত্তর গোলার্ধে এখনও গ্রীষ্মকাল। জুনের একুশ তারিখ সোয়া তিনটায় সূর্য যে অবস্থানে ছিল, জুলাই'র সাতাশ তারিখে দুপুর ঠিক কয়টায় সূর্যটা মোটামুটি আবার সেই একই পজিশনে ছায়া ফেলবে - এটা আমি দু'তিন লাইনের অঙ্ক করে বের করে দিতে পারব।"
তানি বাবা'র টেবিল থেকে প্যাড আর কলম টেনে নিল।
"ওহ গ্রেট !", ওয়াদুদের মুগ্ধতা কাটার মত না। তারেকের দিকে তাকিয়ে বলল, "ছবিগুলো পাওয়া গেলে তো হইচই পড়ে যাবে ! আমাদের দেশে তো পেইন্টিংস নিয়ে এতবড় কেলেংকারী আগে কখনও হয়নি বোধহয়, কী বল?"
"না পাপা", তানি খানিকটা আহত কন্ঠে আবার মুখ তুলল, "আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মিউজিয়াম থেকে তাঁর ১৭টা অমূল্য পেইন্টিংস চুরি হয়ে গিয়েছিল ১৯৮২ সালে। পরে ৯৪ সালে দশ'টা উদ্ধার করা হয়। বাকিগুলো'র আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি কখনও"
"কী বলিস ! জানতাম না তো !"
"ওটাই তো দুঃখজনক। আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, আর তার পেইন্টিংস হারানোর কথা আমরা অনেকেই জানিও না। অবশ্য যে পেইন্টিংসগুলো আছে, সেগুলো দেখতেও আমরা ক'জন যাই?"
ওয়াদুদ মাথা নামালেন, "হুম। অথচ ওয়েস্টে জন্মালে এ শিল্পী কী পরিমাণ সমাদর পেতেন..."
"এখনও পান তো !", তানি খানিক খুশিতে বলে উঠল, "জানো পাপা, বুধ গ্রহের একটা আগ্নেয় জ্বালামুখের নাম রাখা হয়েছে 'আবেদীন' ! আমাদের শিল্পাচার্যের নামে ! আমাদের আগুন-পাখি !"
"তাই নাকি? কবে এটা?"
"২০০৯-এর দিকে বোধহয়"
"এ তো খুব আগের কথা না ! আমরা কেউ এ নিউজ জানি না কেন?"
"হয়তো আমরা তখন গম-চুরি, টিন-চুরি'র নিউজ জানায় ব্যস্ত ছিলাম... আচ্ছা বাদ দাও...", তানি মাথা নিচু করে হিসাব করতে বসল। ওয়াদুদ কেমন উদাস চোখে দূরে তাকিয়ে রইলেন। আর নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বললেন, "আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, ক্ষমা কোরো।" 



********************************************************************

পরের ঘটনা সামান্য। সেদিন বিকালের মাঝে বাংলো'তে পৌছাঁনো সম্ভব ছিল না। ওয়াদুদ পরদিন তার ফোর্স নিয়ে সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলেন। চিমনি'র ছায়াটা যেদিকটায় নিয়ে গেল, ওখান থেকেই মোটামুটি জঙ্গলের শুরু, তাই ওদিকটা কেউ মাড়ায় না। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানা গেল, ডাকাতির সপ্তা'দুয়েক আগে বাগানে মাটি ভরাট করার জন্যে ওদিক থেকে মাটি খোঁড়া হয়েছিল। হয়তো খনন শেষে কোনও এক নির্জন সময়ে সমর সেন তার অমুল্য সম্পদ'টা ওখানে মাটিচাপা দিয়ে এসেছিলেন - এখানের কেউ সেটা জানত না।

তানি যে সময়ের হিসাব দিয়েছিল, ওয়াদুদ তার প্রায় একঘন্টা আগে থেকেই লোকেশন আন্দাজ করে খনন শুরু করার নির্দেশ দেন, অধৈর্য হয়ে। এতে অবশ্য ছবি'র ক্ষতি হয়নি, তবে তাকে আশেপাশের বেশ অনেকটা জায়গা খুঁড়তে হল।

পেইন্টিংসগুলো একটা তুলনামূলক কম ওজনের মেটাল বক্সে ছিল। ৫জন শিল্পী'র ৬টা ছবি। প্রতিটা ছবির সাথে ক্রয়ের রশিদ আর দরকারি কাগজপত্র সব ছিল। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের কারও পেইন্টিংস ওখানে ছিল না, অন্তত তানি যাদের নাম জানত - এমন কেউ ছিল না। সে আশা করেছিল, একেবারে ক্লদ মনে', রেনোয়া বা পিসারো না হোক, অন্তত বার্থ মরিসে' বা বাযিলে'র ছবি তো একটা থাকতেই পারে। কেউ ছিলেন না। তবে তার চেনা-জানার মধ্যে প্রি-ইম্প্রেশনিস্ট সময়ের আরেক গ্রেট 'গুস্তাভ ক্যুরবে'র এটা ছোট আর্টওয়ার্ক পাওয়া গেল ! তানি ওতেই আনন্দে আত্মহারা !

আর সবশেষে, এই পেইন্টিংস উদ্ধারের গল্পে তানি'র নাম পত্রিকায় এসেছিল; তবে... ছয় নম্বর পাতায়। সেদিন পেপারের প্রথম চার পাতা জুড়ে ছিল দুই রাজনৈতিক দলের সহিংসতা, লাগাতার হরতাল, মারপিটের বিশাল সব ছবি। আর পঞ্চম পাতা ভরে গিয়েছিল এক সাবেক সংসদ সদস্যের দূর্নীতি'র বিশাল ফিরিস্তি নিয়ে ফলো-আপ নিউজে।

নিঃসন্দেহে ওসব ঢের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।


** শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে নিয়ে লেখা তথ্যগুলো এই লেখা প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সত্য বলে জানা। (সূত্র: নেট ঘাটলেই পাবেন)
** 'অদিতি' শব্দটার অর্থ জানানোর জন্যে রানা ভাই (ব্লগার 'নস্টালজিক')-এর কাছে লেখক এবং তানি দুজনই কৃতজ্ঞ।


অন্যত্র প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/shahedk/29833177

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন