| কামিল পিসারো |
ধর্মীয় বাঁধা থাকুক বা না থাকুক, পিসারো'র ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি'র অভ্যাস ছিল। তার উপর পারিবারিক একটা বিব্রতকর কাহিনী'র জন্যে তার ফ্যামিলি ছিল স্থানীয় ইহুদী সমাজে রীতিমত একঘরে (ওই বিব্রতকর কাহিনীটা এখানে বলতে চাইছি না, সেটা পোস্টের উদ্দেশ্য না)। যাই হোক, এসব কারণে ধর্মের টান প্রবল থাকার কথা না। কিশোর বয়সে বাবা তাকে ফ্রান্সের এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন। ক্রমেই আর্টের প্রতি তার আকর্ষণ আর দক্ষতা বাড়তে থাকে, শুধু ছবি আঁকার জন্য এক আর্টিস্ট বন্ধুর সাথে তিনি বছরদুয়েক ভেনেজুয়েলাতেও কাটিয়ে আসেন। বয়স যখন পঁচিশ, কামিল পিসারো প্রথমবারের মত পা রাখেন চিত্ররূপময় জগৎ প্যারিসে ! তখনকার সময়ের গ্রেট আর্টিস্ট গুস্তাভ ক্যুরবে', জাঁ ফ্রাঁসোয়া মিল্যে, কামিল করোট'দের সংস্পর্শে এসে পিসারো আরো পরিণত হয়ে উঠতে থাকেন। এ কিন্তু সেই 'কামিল করোট', যিনি বার্থ মরিস' আর তার বোন এডমা'কেও শিল্পীসমাজে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন।
"Work at the same time upon sky, water, branches, ground, keeping everything going on and equal basis and unceasingly rework until you have got it. Paint generously and unhesitatingly, for it is best not to lose the first impression."
[ Rewald, John. The History of Impressionism, Harry Abrams, (1990) p. 458]
কোনও রকম দ্বিধা ছাড়া, উদার মনে ব্রাশ চালিয়ে যেতে। দৃশ্যটা মনের মাঝে যে প্রাথমিক ইম্প্রেশন তৈরি করে - সেটাকেই ধরে রাখতে ! পরে আবার ঘরের মাঝে গিয়ে কল্পনার রং মিশিয়ে ছবিকে 'পারফেক্ট' করার চেষ্টা তার কাছে ছিল একেবারেই অনর্থক একটা কাজ - "It is absurd to look for perfection."
এসব কারণে করোট এবং অন্যান্যদের সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দেয়। কারণ অন্যদের মত কল্পনার রং চড়িয়ে পিসারো প্রকৃতির 'গৌরবময় গাম্ভীর্য'কে ফুটিয়ে তুলছিলেন না, তার ছবিতে ছিল চলমান বাস্তবতা। এবং তার মতের আর পথের লোকজন হিসেবে তিনি দেখা পেলেন কয়েকজন কমবয়সী তরুণ শিল্পী'র - এদের ব্রাশের কাজও অবাধ্য আর জোরালো, এদের ছবিগুলোও জীবন্ত আর চঞ্চল, এদের নামগুলো - ক্লদ মনে', ফ্রেডরিখ বাযিল, রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলী... শুরু হল এক নাটকীয় ইতিহাস ! আমি আগে থেকেই বলে আসছি, 'ইম্প্রেশনিজম'-এর ইতিহাস নিয়ে আলাদা করে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে আছে। তার আগে আলাদা আলাদা করে এর শিল্পীদের গল্প বলে যাচ্ছি। যুদ্ধের গল্প শুরু করার আগে এর সৈনিকদের পরিচিত করিয়ে নিই, তাহলে পরে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বুঝতে সুবিধা হবে ! তাই 'ইম্প্রেশনিজম'-এর পুরো গল্পটা স্থগিত রেখে এখন আমরা চলে যাব পিসারো'র ছবির জগতে !
লাইফস্টাইলের ক্ষেত্রেও - রেনোয়া'র ছবিতে নিখুঁত এক্সপ্রেশনে যখন নাগরিক মানুষের উচ্ছাস-চঞ্চলতা ধরা পড়ছে, ঠিক তখন পিসারো'র ছবির লোকগুলোকে দেখা যায় কাজে-কর্মে ভয়ানক ব্যাস্ত !
প্যারিসে পিসারোকে পুরোটা সময় যেতে হয়েছে অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে। মা এবং সৎবোনসহ এগার জনের বিশাল সংসার চালাতে হত তাকে শুধু ছবি-আঁকার পেশায়। এর মাঝে হঠাৎ ভালবেসে বিয়ে করে বসেন মায়ের এক পরিচারিকা'কে। মায়ের কাছে এ বিয়ে গ্রহনযোগ্য হয়নি, ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু পাওয়ার আশাও ছেড়ে পিসারোকে চলে যেতে হল 'ল্যুভসিয়েন' অঞ্চলে। ল্যুভসিয়েনের গ্রামীন সৌন্দর্যের কারণে নয়, পিসারো ওখানে গেলেন, কারণ ওই অঞ্চলে বাড়িভাড়া তখন সবচেয়ে কম। স্ত্রী জুলি ছিলেন নিখাদ লক্ষী ঘরণী, ফুলে-ফসলে ভরিয়ে তুললেন বাড়ির আঙ্গিনা। সরল গ্রামীন নারীদের নিয়ে আঁকা পিসারো'র ছবিগুলোতে সেই জীবনের গল্পগুলো কি স্পষ্ট নয়?
এভাবে পিসারো অন্য এক জীবনের গল্পে ভরিয়ে তুলতে লাগলেন ক্যানভাস, কিন্তু নিখাদ 'ইম্প্রেশনিস্ট' স্টাইলে ! এবং অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্টদেরও তিনি একতাবদ্ধ করে রাখতে লাগলেন, উৎসাহ এবং সমর্থন দিয়ে যেতে লাগলেন ক্রমাগত। প্যারিসের স্যালন এক্সিবিশন থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ইম্প্রেশনিস্ট'রা নিজেদের আলাদা প্রদর্শনী'র আয়োজন করেছিল। পিসারো ছিলেন একমাত্র শিল্পী যিনি ইম্প্রেশনিস্টদের সবক'টা শো'তেই অংশ নিয়েছিলেন এবং সর্বোতভাবে জড়িত ছিলেন। শুধু নিজে আঁকেন নি, অন্য সব শিল্পীকে সমর্থন দিয়ে গেছেন বাবা'র মত। বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মানো পল সেজান যখন একের পর এক অন্ধকার জগৎময় ছবি এঁকে যাচ্ছিলেন, পিসারো তাকে নিয়ে আসেন আলো-ঝলমলে পৃথিবীতে। এরপর তো সেজান নিজেই একসময় হয়ে ওঠেন তার নিজস্ব ধারা'র আইকনিক ফিগার। সেজান কখনও অস্বীকার করেননি পিসারো'র অবদান, পিসারো সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন - "he was a father for me. A man to consult and a little like the good Lord"
| কামিল পিসারো এবং পল সেজান |
শুধু মূল ধারার ইম্প্রেশনিস্টরা না, পিসারো নিবিড় অভিভাবক ছিলেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম, অর্থাৎ পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট যুগের অন্য প্রধান শিল্পীদেরও - ভিনসেন্ট ভ্যান গফ, পল গগ্যাঁ আর জর্জ স্যুরা' ! স্যুরা'কে তিনিই এই গ্রুপে নিয়ে আসেন, আর তার স্টাইলে আকৃষ্ট হয়ে তিনিও স্যুরা'র পদ্ধতিতে ছবি আঁকা শুরু করেন ! তার 'ইগো'-টাইপের কোনও সমস্যাই কখনও ছিল না, দলের নবীনতম সদস্যটার কাছ থেকেও তিনি আগ্রহ নিয়ে শিখতেন, আর সেটা নিজের ছবিতে ব্যবহার করে দেখাতেন ! একটা নতুন ছেলের জন্য এর চেয়ে উৎসাহের আর কী হতে পারে? আর পিসারো'ও কেমন - নতুন যে স্টাইলই তার ভাল লাগত, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সেটা শিখে নিয়ে ওই স্টাইলেও তিনি ওস্তাদ বনে যেতেন ! এক চিত্র সমালোচক পিসারোকে নিয়ে লিখেছিলেন~
"It is difficult to speak of Camille Pissarro . . . What we have here is a fighter from way back, a master who continually grows and courageously adapts to new theories."
তার যেন শেখার ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নেই, উদারতার কোনও সীমা নেই ! এসব পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল, পিসারো যেন সত্যি কোনও উপন্যাসের মহৎ চরিত্র ! তিনি নিজে সারাটা জীবনের চরম অভাবের মধ্যে শিল্পচর্চা করেছেন, তাই কোনও শিল্পীকে সংগ্রাম করতে দেখলে তিনি তার সবটুকু সমর্থন ঢেলে দিতেন।
| স্যুরা'র স্টাইলে 'ডট' বা 'পয়েন্ট' পদ্ধতি ব্যবহার করে আঁকা ছবি |
শহুরে মানুষের ফূর্তিময় জীবন না আঁকলেও, বিশাল-পরিসরে শহরের উদ্দাম-জীবন পিসারো ঠিকই আঁকছিলেন ! তিনি একই স্থানের দৃশ্য বারবার এঁকেছেন, তবে কাইবট'এর মত বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন সময় এবং আব-হাওয়া থেকে !
মঁমার্ত্রে'র সড়কপথের এই চিত্রমালা দেখুন, একটাই দৃশ্য অথচ বিভিন্ন সময় আর বিভিন্ন ঋতুতে~
| বৃষ্টিভেজা দিনে |
| অথবা বিকেলের আলোয় |
| ঘোর আঁধার দিনে |
| মিস্টি কুয়াশার ওপর হালকা রোদে |
| শীতের সকালে |
| বসন্তকালে |
| সূর্যাস্তে |
| কিংবা ভেজা রাতে |
এবং আরও ক'টা আব-হাওয়ায় তিনি তুলে ধরছিলেন প্রাকৃতিক পালাবদলের রূপ। আর এই নিরীক্ষা তিনি করে গেছেন আরও অনেকগুলো লোকেশনে। শহুরে রাজপথের ওপর ঋতুবদল নিয়ে এমন গবেষণার চিন্তা ক'জনের মাথায় আসে?ইম্প্রেশনিস্টদের মাথায় আসে - তারা এসেছিলেন সবকিছু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে !
পিসারো'র ল্যান্ডস্কেপে অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ছায়া'র রং ধরতে পারা ! ছায়া যে শুধু রং গাঢ় করলেই হয় না, বরং এতে আলোক-বর্ণালীর অন্যান্য রংও ছরিয়ে পড়ে - মনে' এবং সিসলীদের সাথে পিসারোও সেই প্রকৃত রং খুঁজে যাচ্ছিলেন ক্রমাগত ! তবে এসব দেখে ভাববেন না, পিসারো শুধু ল্যান্ডস্কেপ বা পরিশ্রমী মানুষদের ফিগার নিয়েই কাজ করেছেন; তার আঁকা পোর্ট্রেটও কিন্তু গাঢ় মমতার। আগেই বলেছি, ছোট-গ্রামীন সংস্কার এবং সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন পিসারো; তাই নারী পুরুষের অবাধ উদযাপন বা এমনকী ন্যুড-স্টাডিতেও তার তেমন চর্চা দেখা যায় না। তিনি পোর্ট্রেট এঁকে গেছেন চেনা-পরিচিত আপন মানুষগুলোর। তার আদুরে ছেলে-মেয়েদের কিছু ছবি নিচে দিলাম~
| সেল্ফ-পোর্ট্রেট |
আমি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাই। বৃষ্টি থেমে এসেছে। নরম সূর্যের আলোয় শহরটা দেখে আমি এবার ভাবতে থকি, বৃষ্টিশেষে আবার পথে নেমে আসা জীবনের এই চঞ্চলতাকে কামিল পিসারো ঠিক কিভাবে দেখতেন...?
সমস্ত ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল ডট কম এবং উইকিপিডিয়া
তথ্য সূত্র:
* বই - Impressionism: A Celebration of Light, by Isabel Kuhl, Parragon books.
* টিভি ডকুমেন্টারী - The Impressionists Painting and Revolution, BBC.
* ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব।
অন্যত্র প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/shahedk/29840248
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন