জর্জ স্যুরা' ইম্প্রেশনিজম আন্দোলনের প্রধানতম শিল্পীদের মধ্যে পড়েন না। বয়সের দিক থেকেও তাকে বলা যায় পিসারো, মনে', দেগা, রেনোয়া'-দের পরের প্রজন্ম। তাই তাকে রাখা হয় 'পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট' কাতারে। ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্টদের গল্প বলতে এসে আমি প্রধান শিল্পীদের বাদ দিয়ে হঠাৎ স্যুরা'র গল্প বলছি, এর কারণ স্যুরা'র স্টাইলের অতুলনীয়তা - আর তার ছবিগুলো'র কিছু চমকপ্রদ ফিচার ! চাপা-স্বভাবের এই ছেলে হঠাৎ এমন একটা ইউনিক স্টাইল নিয়ে হাজির হয়েছিল যে, বাঘা বাঘা ইম্প্রেশনিস্ট'রা পর্যন্ত থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন ! আর্টের সাথে সায়েন্স মিশিয়ে সদ্য টিন-এজ পেরোনো স্যুরা' দেখাতে শুরু করলেন বিস্ময়কর এক কর্মকান্ড, যেটা দেখার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিলেন না!
| (স্যুরা'র ফটোগ্রাফ। এই একটা ছবি ছাড়া ব্যক্তি স্যুরা'কে চেনার মত আর খুব বেশি কিছু পাওয়া যায়নি !) |
১৮৫৯ সালের ডিসেম্বরে স্যুরা'র জন্ম, চিত্রকলা'র স্বর্গ প্যারিসে। ১৮ বছর বয়সে তিনি ফ্রান্সের (এমনকি বিশ্বেরও) অন্যতম ঐতিহ্যবাহী আর্ট ইন্সটিটিউট École des Beaux-Arts (স্কুল অফ ফাইন আর্টস)-এ ভর্তি হন। তবে ওই স্কুলে তার ছাত্রজীবন স্থায়ী হয়েছিল মাত্র বছরদেড়েকের মত। প্রথাগত কনভেনশনাল আর্ট তাকে টানলো না, বরং তিনি আকৃষ্ট হলেন 'ইম্প্রেশনিস্ট'দের উজ্জ্বল আর বাস্তব জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনিও আঁকতে বসে গেলেন রং-ঝলমলে চেনা জগতের গল্প - কিন্তু একেবারেই ইউনিক আর অচিন্ত্যনীয় একটা ফর্মে ! তার ছবিতে ক্লদ মনে'র মত দৃঢ় ব্রাশ-স্ট্রোক নেই, রেনোয়া'র মত জীবন্ত অভিব্যক্তিও না, দেগা'র মত উজ্জ্বলতার ইল্যুশন বা সেজানের মত গাঢ় রঙের আঁচরও নেই - তিনি ক্যানভাস ভরিয়ে ফেললেন অসংখ্য অসংখ্য ঝিকিমিকি 'ডট' বা 'পয়েন্ট' (বিন্দু) দিয়ে ! কাছ থেকে দেখলে অনেকগুলো ঘন(ডার্ক) রং-এর ফোঁটা, কিন্তু ওই জিনিসই দূর থেকে দেখলে একদম 'আলোর বন্যা' ! কী মেশালেন তিনি ঐ ক্যানভাসে? উত্তরটা হল - বিজ্ঞান ! পিওর সায়েন্স !
École des Beaux-Arts-এ পড়ার সময় স্যুরা' হাতে পান Charles Blanc-এর লেখা 'Grammar of the Art of Drawing' বইটা। Charles Blanc সেই সময় École des Beaux-Arts-এর ডিরেক্টর। তার বইয়ে রং ব্যবহারের নীতি'র (Laws for colors) উপর জানতে পারেন স্যুরা'। আগ্রহী শিল্পী এরপর নিজেই শুরু করেন বিস্তারিত গবেষণা। আলোর মিশ্রণ আর রঙের মিশ্রণের মাঝে দেখতে লাগলেন চমকপ্রদ পার্থক্য ! ব্যাপারটা একদম সহজ করে বলি, শাদা কাগজে রং-তুলি দিয়ে লাল রং, তার উপর নীল রং আর তার উপর সবুজ রং মেশালে - সবটা মিলে একটা গাঢ় মেরুন-টাইপের রং চলে আসে। কিন্তু একটা কাগজে আলাদা আলাদা করে পাশাপাশি লাল, নীল আর সবুজ রং করে কাগজটাকে ফ্যানের স্পীডে জোরে ঘুরালে দেখা যায় উজ্জ্বল একটা একটা রং দেখা যাচ্ছে ! রংটা সাদা'র কাছাকাছি, খুব উজ্জ্বল বাদামীও বলা যায় ! মানে দাড়ালো - মৌলিক তিনটা রং মেশালে ফলাফলটা আসে গাঢ় একটা শেড, কিন্তু ওই তিন রঙের আলো মেশালে পাওয়া যাচ্ছে উজ্জ্বল একটা কালার ! স্যুরা' এই অসীম সাহসী কাজটা করে বসলেন ক্যানভাসে। তুলি'র কোনও রং-কে তিনি অন্য রঙের সাথে মেশালেন না, বরং প্রত্যেকটা মৌলিক রঙের অসংখ্য বিন্দু পাশাপাশি বসিয়ে দিলেন ! ফলাফল'টা কী হল নিজের চোখেই দেখুন -
আরও উদাহরণ দেখতে পারেন -
অপটিক্স - এটাই ছিল স্যুরা'র চিত্রকর্মের অন্যতম প্রধান উপাদান। ছবি আঁকার জন্য কোন শিল্পী থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের গবেষণা করতে বসবে? এ কাজ শুধু ইম্প্রেশনিস্টদের পক্ষেই সম্ভব - ব্যতিক্রম কিছু করাটাই ছিল তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, তার ওপর স্যুরা' তো ছিলেন তাদের মাঝেও ব্যতিক্রম একজন ! স্পষ্টতই - "His interest extended beyond painting to the science of optics. Seurat embraced theories of color, studied the works of Delacroix, and learned from material published by scientists…" [Impressionism: Isabel Kuhl, Parragon Books. Page 164]
ইম্প্রেশনিস্টদের গ্যালারীতে স্যুরা'র পেইন্টিং প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৮৮৬ সালে। সেবছরই ছিল সর্বশেষ 'ইম্প্রেশনিস্ট এক্সিবিশন'। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলনের যখন প্রায় সমাপ্তি তখনই স্যুরা'র সবেমাত্র শুরু। স্যুরা' প্রদর্শন করলেন দুই বছর ধরে আঁকা তার বড় ক্যানভাসের (প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত) ছবি "A Sunday Afternoon on the Island of La Grande Jatte"। প্রথম দানেই প্রায় বাজিমাত ! হঠাৎ করে মনে হচ্ছিল ইম্প্রেশনিজম-এ মনে', রেনোয়া', দেগা'রা যথেষ্ঠ ছিলেন না; আরও কিছু বাকি ছিল - সেই কিছু'টা নিয়ে এলেন এই রহস্যময় তরুণ জর্জ স্যুরা' !
| A Sunday Afternoon on the Island of La Grande Jatte [1884-1885] |
স্যুরা'র ছবিতে ফিরে যাই। উপরের ছবিটার আগে ১৮৮৩-তে স্যুরা আঁকেন 'Bathers at Asnières', যেটা ছিল তার প্রথম মাস্টারপিস।
| Bathers at Asnières [1883] |
স্যুরা' তার ম্যাজিক ইফেক্ট দেখানোর জন্য আরও অনেক নিরীক্ষা করতে লাগলেন। আরেকটা চমকপ্রদ ব্যাপার বলি। আপনি যদি বেশ খানিকক্ষণ ঘন লাল রঙের দিকে তাকিয়ে থাকেন, হঠাৎ করে ঐ লাল বস্তু সরিয়ে নেয়া হলে আপনার চোখের সামনে লাল-এর বিপরীত একটা হালকা উজ্জ্বল সবুজ আভা থেকে যাবে। স্যুরা' এই ইফেক্ট অ্যাপ্লাই করে সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে জায়গামত অসংখ্য লাল ডট রাখলেন, যে লাল-রং খালি চোখে দৃশ্যমান হল না, কিন্তু আপনার রেটিনা ঠিকই সেই তরঙ্গ রিসিভ করে তার ইফেক্ট হিসেবে ঘাসের সবুজকে আরও উজ্জ্বল সবুজ করে তুলল ! এখনও স্বীকার করতে আপত্তি আছে, স্যুরা' দর্শকের রেটিনা নিয়ে খেলছেন না?
আর স্যুরা'র ছবির মানুষগুলো'র কী যেন সমস্যা আছে। নিচের ছবিটাই দেখুন -
ছবি'র বিষয়বস্তু যাই হোক, ফর্ম আর টেকনিকে স্যুরা অনন্য কিছু কীর্তি রেখে গেছেন, যা পরবর্তী শিল্পজগতে বিস্তর প্রভাব ফেলে। এমন বিজ্ঞানময় শিল্পের কথা অতিরিক্ত প্রতিভাবান ছাড়া আর কার মাথায় আসতো?
সমস্ত ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল ডট কম এবং উইকিপিডিয়া
তথ্য সূত্র:
* বই - Impressionism: A Celebration of Light, by Isabel Kuhl, Parragon books.
* টিভি ডকুমেন্টারী - The Impressionists Painting and Revolution, BBC.
* ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব।
অন্যত্র প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/shahedk/29838238
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন