গল্পটা শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে থেকে আমি গল্পটা বলতে শুরু করলাম।
সাতসকালের গল্প। তিনতলার ওই নীল-শার্ট পড়া ছেলেটা ভোরবেলা থেকেই তার পুরানো গীটারে হালকা রিদম ধরেছে। নীচতলার ফলের দোকানদার তার দোকানের ঝাঁপ খুলে বেসাতি সাজাতে ব্যস্ত। রাস্তার ওপারে তিনজন বুড়োমানুষ চা-হাতে আড্ডায় বসা। যুদ্ধের অবস্থা খুব খারাপ, রাজধানীতে যখন-তখন বোমাবর্ষণ হচ্ছে - তাই এসব গল্প ছাড়া আড্ডায় অন্য কোনও টপিকের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যায় না।
দোতলা'র ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোশি নিজেকে আরেকবার দেখে নিল। নিতু কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, সে টের পায়নি। এতটা পরিপাটি সাজ তোশি সাধারণত নেয় না, সে নিজে থেকে কিছু বলছেও না; কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নিতু তাই প্রশ্ন করেই বসল, "কি ব্যাপার? আজ হঠাৎ এমন সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছ?"
আয়নায় চোখ রেখেই তোশি হালকা হেসে বলল, "ডেটিং-এ যাচ্ছি। অফিসের ফ্রন্ট-ডেস্কের মেয়েটার সাথে আজ লাঞ্চে যাওয়ার কথা..."
নিতু প্রচন্ড সেন্সিটিভ মেয়ে। এ ধরণের রসিকতা তার অসহ্য, এটা জেনেই তোশি তাকে আরও বেশি করে ক্ষ্যাপায় মাঝে মাঝে। নিতু এখনও চুপ করে আছে, মনে হয় মেঘ জমছে। তোশি শেষবারের মত আয়নার দিকে তাকাল। পুরো ঘরের হতদরিদ্র দশা'র মাঝে এই আয়নাটাই শুধু ঝাঁ-চকচকে, যেন দারিদ্রের প্রতিফলনকে ঠিকঠাকমত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে আয়নাটা রীতিমত বদ্ধপরিকর !
তোশি খেয়াল করেনি, নিতু তার একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ঘুরে দাঁড়াতেই নিতু তার বুকের খুব কাছাকাছি লুকালো।
'আরে পাগলী? আমি কি কখনও একটু দুষ্টামিও করতে পারব না?'
'আমি কি কিছু বলেছি?', নিতু নরম গলায় জবাব দিল। তা ঠিক, নিতু কিছু বলেও নি। তোশি চাইছিল নিতু কিছু বলুক, তারপর আরও কিছুক্ষণ দুষ্টামি করে তাকে অস্থির করে শেষে বাঁধভাঙা আদরে তাকে জড়িয়ে নেবে - এই ধরণের চমৎকার একটা প্ল্যান ভেস্তে যাওয়াতে তোশি খানিকটা হতাশ হল।
'আচ্ছা এখন ওঠো? আজ একটা ইন্টারভিউ দিতে যাব, একারণে এমন সাজ-পোষাক...'
তোশি'র কথাগুলো নিতুর কানে গেল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। সে আরও কিছুক্ষণ তোশি'কে জড়িয়ে রাখল, তারপর ফিসফিস করে বলল, 'আর শোনো? তুমি পারবে না...' নিতু মুখ লুকিয়ে বলল, 'এই ধরণের দুষ্টামি তুমি কখনও করতে পারবা না। আমার ভাল লাগে না...'
পরম আদরে তোশি নিতু'কে জড়িয়ে তাদের ঘরটা'র দিকে তাকাল। কী দৈন্যদশা! এতটা দৈন্যতা তাদের ছিল না, তবে দীর্ঘ যুদ্ধের দামামায় একে একে তারা সবই হারিয়েছে, হারাচ্ছে। এখন 'ভালবাসা' ছাড়া পুরো ঘরে বলার মত আর একটা ফার্নিচারও নেই তাদের। দেয়ালে-চৌকাঠে সবখানে শুধু আদর আর মমতা ছড়িয়ে আছে। এর মাঝেই এই মেয়েটা তাকে পাগলের মত আঁকড়ে আছে।
'নিতু, এখন ওঠো? এত যত্ন করে নতুন শার্ট'টা পড়লাম, ইন্টারভিউ দিতে যাবার আগে কেঁদে-কেটে আমার বুক ভিজিয়ে দেবে নাকি?'
নিতু তৎক্ষণাৎ উঠে গেল। মুখ নিচু রেখে চুল ঠিক করে কিচেনের দিকে চলে গেল দ্রুত। যাওয়ার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে একবার ঘুরে দাঁড়াল, 'শোনো? ওটা আমার জায়গা। আমি কেঁদে-কেটে ভিজাব না কী করব, সেটা আমার ইচ্ছা !' বলেই সে ছুটে পালাল।
অদ্ভূত আলোমাখা একটা মুখ আয়নাতে স্থির হল কিছুক্ষণ।
এদিকে তাদের কাঠের দেয়ালের অবস্থা বিশেষ ভাল না। দেয়ালের ওপার থেকে তোনি তার ভাই-ভাবী'র কথোপকথনের প্রায় পুরোটাই শুনল। মনে মনে প্রার্থনা করল, এমন একটা সংসার কি সেও পাবে না? অত স্বচ্ছলতা তার দরকার নেই, ভালবাসতে জানলে জীবনে সুখী হতে আর খুব বেশি কিছু লাগে না। ঘুম-ভাঙা চোখে সে কুরুশ-কাঁটা আর সোয়েটার'টা টেনে নিল তোনি। সে যার জন্য সোয়েটার বুনছে, ওই ছেলে জানে না তোনি নামে একটা মেয়ে কী গভীর মমতা তার জন্য পুষে রেখেছে। উদাসী ছেলেটা এখন তিনতলা'র ছোট কামরায় তার গীটার নিয়ে বসা।
গীটারের তিন-নাম্বার তার'টা ছিঁড়ে গেছে। ভাল বিপদে পড়া গেল - এই তার'টা ছাড়া সব সুরই কেমন অসম্পূর্ণ আসে। নীল-শার্ট পড়া ছেলেটা জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকল। ফলের দোকানের সামনে পিচ্চি দুইটা ছেলে খেলছে আর ছোটাছুটি করছে। দোকানদার তাদের মৃদু ধমক দিয়ে ওঠে। আড্ডায় বসা তিন বুড়ো'র একজন সেদিকে ফিরে তাকাল। অলস নাপিত তার সেলুন থেকে বেরিয়ে এসে রোজকার মত সূর্যের দিকে মুখ করে আড়মোড়া ভাঙে।
ছোট্ট মেয়ে ওনি তার বাবা তোশি'র হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে নিতু ওনি'র কপালে আর গালে আদরে চুমু খেল। তোশি'র গালেও এমন চুমু দিতে ইচ্ছা হয় প্রতিদিন, লজ্জায় আর ইচ্ছাপূরণ হয়ে ওঠেনি কখনও। কিন্তু আজ কী হল কে জানে, যাওয়ার আগে তোশি হঠাৎ নিতু'র গালে তার আঙুল রাখল কিছুক্ষণ, তারপর ফিসফিস করে বলে গেল, 'ভালবাসি'।
তোশি যে তাকে ভালবাসে, একথা নিতু বিলক্ষণ জানে; তবু হঠাৎ এভাবে শোনার পর নিতু'র আজ অকারণ আনন্দে কান্না চলে আসল। এইটুকুই তো তার পৃথিবী, আর এই এক পৃথিবীর সমস্তটা সে পেয়েছে। তার আর কিছুই চাওয়ার নেই... চোখ বন্ধ করে নিতু কী এক প্রার্থনা করে।
আমাদের গল্পে প্রার্থনার সময় ঘনিয়ে আসে।
তিনতলার ঐ নীলশার্ট পড়া ছেলেটা ওই তার-ছেঁড়া গীটারেই অসম্পূর্ণ সুরে রিদম তোলে। হঠাৎ দোতলা'র বারান্দায় চোখ যায় তার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোনি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ছেলেটা তাকাতেই তোনি ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ে, তার বুক ঢিবঢিব করছে। ওদিকে নিচে কী একটা গন্ডগোল শোনা যায়। পিচ্চি ছেলে দু'টো খেলতে খেলতে ছুটে পালানোর সময় ফলের একটা ট্রে রাস্তার ওপর পড়ে যায় - পুরো রাস্তাজুড়ে ফল গড়িয়ে পড়ছে। ফলের দোকানদার কোমরে হাত দিয়ে বিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আড্ডায় বসা তিন বুড়ো খিকখিক করে হেসে ওঠে। নাপিত সেই আওয়াজ শুনে তার চুল-কাটায় ইস্তফা দিয়ে খানিকক্ষণের জন্য তামাশা দেখতে বেরিয়ে আসে।
ঘড়িতে সময় তখন আট'টা পনের।
ছোট্ট ওনি বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে স্কুলের দিকে যায়। কোন এক পরিচিত ছড়া'র তালে পুতুল-পুতুল মেয়েটা দুলছে, দুলছে তার ছোট্ট দু'টা চুলের বেণী।
সময় আট'টা পনের।
হঠাৎ করে এক পৃথিবীর এই সমস্ত গল্পগুলো শেষ হয়ে গেল।
চিরতরে।
গল্পশেষে আলাদা কথা:
৬ অগাস্ট, ১৯৪৫। সময় - সকাল আট'টা পনের। মার্কিন বোমারু বিমান Enola Gay থেকে পারমানবিক বোমা "Little Boy"কে হিরোশিমা নগরীর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী কাহিনী তো মোটামুটি সবার জানা। "...its residents were vaporized", যেমনটা বলা হয়েছে Mark E. Van Rhyn-এর জার্নালে, "All died in less than a second." [উইকি'র সূত্রে পাওয়া]
Enola Gay থেকে "Little Boy"-কে ছেড়ে দেয়ার পর মাটিতে এসে এর বিস্ফোরিত হতে সময় লেগেছিল আরও ৪৩ সেকেন্ড। ততক্ষণে Enola Gay চলে গিয়েছিল আরও সাড়ে ১৮ কিলোমিটার দূরে। ওই দুরত্ব থেকেই পাইলট Colonel Paul W. Tibbets বিস্ফোরণের ধাক্কাটা অনুভব করেছিল।
আপনাকে যদি এখন ১, ২,...করে সেকেন্ড গণনা শুরু করতে বলি, আপনি হঠাৎ আবিস্কার করবেন, চিন্তা-ভাবনা করার জন্য ৪৩ সেকেন্ড কিন্তু নেহাৎ কম সময় না ! উপরে সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই একজন আছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, ওই ৪৩ সেকেন্ড সময় জুড়ে তিনি ঠিক কী ভাবছিলেন?
অন্যত্র প্রকাশঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/shahedk/29861783
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন